আমাদের বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেতে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের এক মহান সাক্ষ্যি হয়ে জমিদার বাড়িগুলো। এই জমিদার বাড়িগুলোর প্রতিটির সাথে রয়েছে হাজারো জানা-অজানা ইতিহাসের ডেলা। কিছুদিন হল শুরু করেছি "বাংলার জমিদার বাড়ী" সিরিজ। আজ আমরা দেখব “পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি” এবং তার ইতিহাস। আশা করি আমার এই সিরিজের সাথে আপনাদের সবাইকে সবসময় কাছে পাবো। আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ আমাদেরই করতে হবে। তবে আসুন শুরু করা যাক। এবার নিজ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখা শুরু করা যাক।
"বাংলার জমিদার বাড়ী" - পর্ব ১ (বালিয়াটি জমিদার বাড়ি)
সকাল সাড়ে ছয়টায় আজিমপুর থেকে চৌদ্দ সিটের মাইক্রোবাস নিয়ে আমি রওনা দিলাম। পথে থেমে থেমে বাকি সাত সদস্যকে তুলে নিলাম। সবশেষে দলনেতা তাহসিন মামাকে সাভার থেকে তুলে নিয়ে গাড়ি মানিকগঞ্জ অভিমুখে চলতে লাগল। গাড়ি যখন সাভার স্মৃতিসৌধ পার হচ্ছে তখন তাহসিন মামা প্রস্তাব করল হাতে যেহেতু প্রচুর সময় আছে আমরা স্মৃতিসৌধতে থামতে পারি। প্রস্তাব করা মাত্রই গাড়ি থামিয়ে সবাই নেমে পড়লাম।
সকালের নরম রোঁদে স্মৃতিসৌধর অঙ্গনে ঘুরে বেড়ালাম আটজনা, ক্যামেরার সাটার পরতে লাগল ঘনঘন। আনন্দঘন কিছু সময় কাটিয়ে, অসাধারণ কিছু ছবি তুলে আমরা আবার গাড়ীতে উঠে বসলাম, গাড়ী চলতে শুরু করল মানিকগঞ্জের দিকে।
আমরা আড্ডায় এতটাই মত্ত ছিলাম যে গাড়ি অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছিল, ফলে অনেকটা ঘুরতি পথে আমরা টাঙ্গাইলের ঘাটাইলস্থ পাকুটিয়া রওনা হলাম। একটু ঘুরে যাওয়াতে মন্দ হল না, বাংলার চিরচারিত গ্রাম্য পথ আজ পিচঢালা কৃষ্ণরূপ পেয়েছে, সেই পথ ধরে ছুটে চললাম পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম পাকুটিয়া প্যালেসে।
এককালে পশ্চিম বঙ্গের বিষ্ণপুর থেকে প্রথমে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল নামের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি পাকুটিয়াতে বশত স্থাপন করেন। এটি ঊনবিংশ শতাব্দীর ঠিক শুরুতে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্রয় সূত্রে তাঁদের জমিদারী শুরু হয়। রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডলের দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ নিঃসন্তান কিন্তু বৃন্দাবন চন্দ্রের তিন ছেলে- ব্রজেন্দ্র মোহন , উপেন্দ্র মোহন এবং যোগেন্দ্র মোহন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারী তিনটি তরফে বিভক্ত ছিল। প্রধান তিনটি স্থাপনাই অপূর্ব শিল্প সুষমমন্ডিত। পাশ্চত্তীয় শিল্প সংস্কৃতি সমৃদ্ধ মনের মাধুরী মিশিয়ে স্থাপত্য মূল্যের এক অনন্য সৃষ্টি তাদের এই অট্টালিকা। তিনটি বাড়ীর সামনেই তিনটি নাট মন্দির। দেশ বিভাগের পরে তৎকালীন সরকার কর্তৃক পুরো সম্পদ অধিগ্রহণের পর জমিদারদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ ১৯৬৭ সালে এই সম্পদের উপর গড়ে তোলা হয় বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজ।
আমরা প্রথমে একেবারে শেষের ভবন যা প্রায় ভগ্নাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গাড়ি পার্ক করে হালকা নাস্তা করে নিলাম। এরপর শুরু হল ঘুরে দেখা। ভগ্ন দালানটির আশেপাশে ঘুরে দেখলাম, ছবি তুললাম। বারে বারে মন হল আজ থেকে মাত্র শত বছর আগেও এটি একজন প্রতাপশালী জমিদারের বাড়ির অংশ ছিল, আর আজ তা এক পরিত্যাক্ত ভগ্নাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পর আমরা পরের দালানগুলো ঘুরে দেখলাম। সবশেষে রয়েছে যে ভবন তাতে এখন কলেজটি চলছে।
কলকাতা ভিক্টোরিয়া প্যালেস, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্দনিক সৌন্দর্য্যের মিশেলে ভবনগুলো নির্মিত। ভবনগুলোর সীমানা ঘেঁষে প্রবেশ পথে রয়েছে বিশাল এক পুকুর, পুকুর না বলে দীঘি বললে বেশী ভালো মনে হবে। আপনি এর পানি দেখে সাথে সাথে নেমে যেতে চাইবেন গোসলে। আমাদেরও মন চাইছিল, কিন্তু কোন পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় সেই ইচ্ছার আর বাস্তব প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ঘণ্টা দুয়ে’ক আমরা সেখানে কাটিয়ে মধ্য দুপুরে রওনা হয়ে যাই মানিকগঞ্জের সাটুরিয়াস্থ বালিয়াটি প্যালেসের উদ্দেশ্য, রেখে যাই কিছু স্মৃতি, ফেলে যাই কিছু ভালো লাগা ক্ষণ।
পাকুটিয়ার জমিদার ও জমিদার বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার অর্ন্তগত নাগরপুর উপজেলা প্রাচীন লৌহজং নদীর তীরে অবস্থিত। নাগরপুর মূলতঃ নদী তীরবর্তী এলাকা হওয়ার কারনেই অতীতে নাগরপুরে গড়ে উঠে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা কেন্দ্র। ব-দ্বীপ সদৃশ নাগরপুরের পূর্বে ধলেশ্বরী এবং পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে যমুনা নদী। একসময় এই যমুনা নদীর মাধ্যমে নাগরপুর এলাকার সাথে সরাসরি কলকাতার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগ ছিল। সলিমাবাদের বিনানইর ঘাট তখন খুবই বিখ্যাত ছিল। ইংরেজ আমলের শেষ দিকে এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই ঘাট থেকেই তৎকালীন বৃটিশ রাজাধানী কলকাতার সাথে মেইল স্টিমারসহ মাল এবং যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। ফলে নাগরপুরের সাথে রাজধানী কলকাতার একটি বানিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর এরই সূত্র ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক মোঘল আমলের সূচনা লগ্নে নাগরপুরে সুবিদ্ধা খাঁ-র হাত ধরে নাগরপুরের বিখ্যাত ‘চৌধুরী’ বংশের আর্বিভাব ঘটে। আরো পরে সুবিদ্ধা খাঁ-র পথ অনুসরন করে পশ্চিম বঙ্গ কলকাতা থেকে আসেন রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁর জন্মস্থান বিষ্ণপুর, যাহা পশ্চিম বঙ্গের বাকুরা, মেদেনীপুর, বর্ধমান ও শাওতাল পরগনায় কিয়দংশ ও ছোট নাগপুরের অধিত্যক্তা ভূমির কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল প্রথমে ছনকায় অবস্থান নেন পরর্বতীতে নদী ভাঙ্গনের কারণে হাড়িপাড়া হয়ে অপেক্ষাকৃত উচু ভূমি পাকুটিয়াতে তাঁর স্থায়ী বসতী স্থাপন করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজদের কাছ থেকে ক্রয় সূত্রে মালিক হয়ে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল পাকুটিয়ায় জমিদারী শুরু করেন। তাঁর ছিল দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ ছিলেন নিঃসন্তান এবং বৃন্দাবন চন্দ্রের ছিল তিন ছেলে। এরা হলেন- ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন। বৃন্দাবনের মেজছেলে উপেন্দ্রকে তাঁর কাকা নিঃসন্তান রাধা গোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র মোহন দত্তক সন্তান হিসাবে কাকার জমিদারীর পুরো সম্পদের অংশটুকু লাভ করেন। ১৯১৫ সালের ১৫ই এপ্রিল প্রায় ১৫ একর এলাকা জুড়ে তিন ভাইয়ের নামে উদ্ভোদন করা হয় একই নকশার পর পর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা। পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি তিন মহলা বা তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। প্রতিটি মহলের রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য, লতাপাতার চমৎকার কারুকাজ গুলো মুগ্ধ করার মতো। প্রতিটি জমিদার বাড়ীর মাঝ বরাবর মুকুট হিসাবে লতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্য মন্ডিত পূর্ণাঙ্গ দুই সুন্দরী নারী মূর্ত্তি এবং সাথে এক মূয়ূর সম্ভাষণ জানাচ্ছে অথিতিকে। এছাড়া দ্বিতীয় তলার রেলিং টপ বা কার্নিশের উপর রয়েছে পাঁচ ফুট পর পর বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ছোট আকৃতির নারী মূর্ত্তি।
এই তিনটি স্থাপনাই অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত। পাশ্চত্তীয় শিল্প সংস্কৃতি সমৃদ্ধ মনের মাধুরী মিশিয়ে স্থাপত্য মূল্যের এক অনন্য সৃষ্টি তাদের এই অট্টালিকা গুলো। তিনটি বাড়ীর সামনেই রয়েছে তিনটি নাট মন্দির। বড় তরফের পূজা মন্ডপের শিল্পিত কারুকাজ শতবছর পর এখনও পর্যটককে মুগ্ধ করে। জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ আর মাঠের মাঝখানে রয়েছে দ্বিতল নাচঘর। প্রতিটি জমিদার বাড়ির রয়েছে নিজস্ব পাতকূয়া। জমিদার বাড়ির কাছাকাছি পশ্চিমে আছে উপেন্দ্র সরোবর নামে বিশাল একটি আট ঘাটলা পুকুর। এই তিন মহলার জমিদাররা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রজানন্দিত। তাঁদের নিজেদের প্যালেস তৈরীর পর ১৯১৬ খ্রিঃ তাঁরা তাঁদের পিতা বৃন্দাবন এবং কাকা রাধা গোবিন্দের যৌথ নামে বৃন্দবন চন্দ্র রাধা গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় (বিসিআরজি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা উপচার্য এবং সাবেক মন্ত্রী ডঃ এ,আর মল্লিক, সাবেক প্রধান মন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং ভবা পাগলার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ । দেশ বিভাগের পরে তৎকালীন সরকার কর্তৃক পুরো সম্পদ অধিগ্রহণের পর জমিদারদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নিদর্শন স্বরূপ ১৯৬৭ সালে এই সম্পদের উপর গড়ে তোলা হয় বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজ।
তথ্যসূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১১:৩৭